ক্ষমতাসীন জোট-মহাজোটে হতাশা ও ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের সঙ্গী হলেও নতুন মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হয়নি জোট-মহাজোটের নেতাদের। আগে যারা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তাদেরও বাদ দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে শরিকদের ভেতরে ভেতরে যেমন অসন্তোষ রয়েছে তেমনি দূরত্বও দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় কিছু রদবদল হলেও জোট-মহাজোটের কোনো নাম নিশানা নেই। আলোচনা আছে, এ বছরের শেষের দিকে মন্ত্রিসভায় কয়েকজন যুক্ত হতে পারেন। কিন্তু সেখানেও জোট-মহাজোট নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে কি না তা নিয়েও বড় ধরনের সংশয় রয়েছে। জোট নেতারা মনে করেন, বামপন্থী প্রগতিশীল দলগুলোর ওপর ভর করে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ এখন ডানপন্থী রাজনীতির দিকে ঝুঁকছে। এতে গুরুত্ব হারাচ্ছে জোটের বামপন্থী প্রগতিশীল দলগুলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মন্ত্রিসভা ছাড়াও অনেক জায়গা আছে, যেখানে ক্ষমতাসীন জোট-মহাজোটের রাষ্ট্রীয়ভাবে অংশ নেয়ার সুযোগ আছে। সেখানে সরকারের অনীহা থাকায় সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া জোটপ্রধানের সাথে সচরাচর আলোচনায় বসারও সুযোগ পান না শরিক দলগুলো। এমন পরিস্থিতিতে কিছু কর্মসূচি পালন করেও ১৪ দলকে ‘দৃশ্যমান’ রাখা যাচ্ছে না। যদিও জোটের মুখপাত্রকে গুরুত্বসহকারে বিষয়গুলো দেখভাল করার দায়িত্ব দিলেও তিনি কোনো কূলকিনারা করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক নয়া দিগন্তকে বলেন, আগে আমাদের মন্ত্রী-এমপি বেশি ছিল। এখন কম। তিনি বলেন, ১৪ দলকে সক্রিয় করার জন্য জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি কতটুকু কূলকিনারা করতে পারবেন তা তিনিই ভালো জানেন। কিছু কর্মসূচি নিয়ে তিনি শরিকদের ডাক দেন। কেউ অংশগ্রহণ করেন, কেউ করেন না।
শরিক দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর ‘একলা চলো নীতি’ অনুসরণ করছে আওয়ামী লীগ। শরিকদলগুলোর প্রতি আগের মতো তেমন আগ্রহ নেই। ফলে জোটের শরিকদলগুলো আগের মতো গুরুত্ব পাচ্ছে না। যদিও জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিমকে দেখভাল করার জন্য বিশেষভাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনিও প্রাণপণ চেষ্টা করছেন জোট-মহাজোটের বন্ধনকে দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য। জানা গেছে, গত সংসদ নির্বাচনের পর সরকারি দলের কোনো কর্মকাণ্ডে রাখা হচ্ছে না জোটসঙ্গীদের।
মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না পাওয়াসহ উপজেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আলাদা অংশ নেয়ার ঘোষণাকে মূলত একলা চলো নীতি হিসেবে দেখছেন জোটের মিত্ররা। এমনকি জোট থাকলেও ভবিষ্যৎ নির্বাচনে জোটগত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করারও আভাস দেয়া হয়েছে। তা ছাড়া নির্বাচনের পরই বিএনপি শপথ না নেয়ায় তখন আওয়ামী লীগের তরফ থেকে জোট-মহাজোটকে বিরোধী দলের ভূমিকায় সক্রিয় থাকতে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছিল। তখন থেকেই আলাদা চলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে দলগুলো। ইতোমধ্যে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি। তবে জোট-মহাজোটের শরিক দলগুলোকে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের ভূমিকায় থাকতে অনানুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ প্রস্তাব দেয়ার পরই কয়েকটি দল ‘নাখোশ’ হয়।
জোটের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে জোট-মহাজোট জোটগতভাবে অংশ নিলেও আওয়ামী লীগের উদযাপিত ‘বিজয় সমাবেশে’ তাদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ছিল না। গত নির্বাচনের ১৯ দিন পর ১৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের উদযাপিত সমাবেশে জোট-মহাজোটকে অংশ নিতেও আগের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসন বণ্টন নিয়েও আওয়ামী লীগ শরিক দলগুলোর সাথে তেমন আলোচনা না করার অভিযোগ আছে। এবারের মন্ত্রিসভায় শরিক দল থেকে অন্যবারের মতো কাউকে না রাখা এবং মন্ত্রিসভা শতভাগ আওয়ামী লীগের হওয়ার পর থেকে জোট-মহাজোটে মূলত মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জোটের অন্যতম শরিক ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) মো: ইসমাইল হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, আশা থেকে হতাশা সৃষ্টি হয়। আমরা নির্বাচন করেছি জোটগতভাবে। কিন্তু সরকার গঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের। তারা মনে করছে, জোটের শরিকদের ভাগ দিলে কম পড়ে যাবে। এ নিয়ে ক্ষোভ, হতাশা তো আছেই। তিনি মনে করেন, রাজনীতি এখন আগের তুলনায় ডান দিকে সরছে। এজন্য বাম প্রগতিশীলদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। দক্ষিণপন্থীদের দিকে ঝুঁকছে সরকার। যেমন- ভারতে মোদি যেভাবে ক্ষমতায় এসেছে, সে দিকে যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঝুঁকে যান তাহলে ডানপন্থীদের মূল্যায়ন বেশি হয়। এ ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রশ্ন বিদ্ধ হয়। এরকমই মনে করেন জাসদের সহসভাপতি মো: শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের মূল বিষয় ছিল আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠন। আমরা জোটগতভাবে নির্বাচন করেছি। কিন্তু সরকার গঠন জোটগতভাবে হয়নি। শরিকদের মূল্যায়ন করা হয়নি। শহিদুল ইসলাম বলেন, এই মুহূর্তে মোল্লাতন্ত্রকে খুশি করার জন্য জোটের প্রগতিশীলদের সাথে অরাজনৈতিক ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। এতে মোল্লাতন্ত্র আশকারা পেয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ভবিষ্যতে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেয়ার একটি অশুভ ইঙ্গিতের আশঙ্কা থেকেই যায়।
এ প্রসঙ্গে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ নয়া দিগন্তকে বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ১৪ দলের শরিকদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। আমাদের বিরোধী দলে থাকতে বলা হয়েছে। আমরা আছি। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছি। তিনি বলেন, আশাহত হওয়ার মতো অনেক কারণই আছে। এগুলো সময়ের প্রয়োজনে ঠিক হয়ে যাবে।